পর্যটন শিল্প : কক্সবাজারে পর্যটন শিক্ষা ও ক্যারিয়ার (প্রবন্ধ রচনা/রিপোর্ট)
বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পের এক অপার সম্ভাবনাময় দেশ। এদেশের পর্যটন শিল্পকে যদি আরেকটু গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়, তাহলে পর্যটন শিল্প থেকে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।
উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সুন্দর ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন কার না থাকে? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা বেড়ে চলছে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার চাহিদা মেটাতে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুলছে নতুন বিভাগ। ‘ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’ বিভাগটি তেমনি একটি বিভাগ।
বাংলাদেশে পরিচিত অপরিচিত অনেক পর্যটক আকর্ষক স্থান রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে যুগে যুগে অনেক ভ্রমণকারীরা মুগ্ধ হয়েছেন। বাংলাদেশের রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, পাহাড়, অরণ্য ভূমি প্রভৃতি। সেই প্রাচীন কাল থেকেই এদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য পর্যটকদের মন জয় করে এসেছে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি এলাকা বিভিন্ন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত। এ পর্যটন এলাকা গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে। তাই কক্সবাজারে পর্যটন শিক্ষার প্রসার ঘটানো অতীব জরুরী।
সারি সারি ঝাউবন, বালুর নরম বিছানা, সামনে বিশাল সমুদ্র। কক্সবাজার গেলে সকালে-বিকেলে সমুদ্রতীরে হাঁটতে কে না চাইবে। নীল জলরাশি আর শোঁ শোঁ গর্জনের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য সবাইকেই আকৃষ্ট করে। অপরূপ সুন্দর বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, মাতার বাড়ি, শাহপরী, সেন্টমার্টিন, কক্সবাজারকে করেছে আরো আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন। এ জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে মাতা মুহুরী, বাঁকখালী, রেজু, কুহেলিয়অ ও নাফ নদী। পর্যটন, বনজসম্পদ, মৎস্য, শুটকিমাছ, শামুক, ঝিনুক ও সিলিকাসমৃদ্ধ বালুর জন্য কক্সবাজারের অবস্থান তাই ভ্রমণবিলাসী পর্যটকদের কাছে সবার উপরে। আর এই কক্সবাজারে রয়েছে পর্যটন শিল্পের বিশাল এক সম্ভাবনা। আর এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন এই বিষয়ের উপর পর্যাপ্ত জ্ঞান। তাই পর্যটন শিক্ষা আমাদের কক্সবাজারের যুবকদের জন্য বিশাল এক সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে।
অপার সম্ভাবনার পর্যটন খাত চলছে খুঁড়িয়ে।
পর্যটনকে বলা হয় ‘অদৃশ্য রপ্তানি পণ্য’। এখানে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও আয়ের কোনো সীমা নেই। মেক্সিকো ও ইন্দোনেশিয়ার মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৬০ ভাগ আসে পর্যটন খাত থেকে। গত বছর বিশ্বের মোট কর্মসংস্থানের ৯.৩ শতাংশ ছিল পর্যটন খাতে। পর্যটনের বিকাশ ঘটিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ, তিউনেসিয়ার মতো অনেক দেশ বেকারত্ব দূর ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করতে সমর্থ হয়েছে। অথচ, বিশ্বের অন্যতম পর্যটনবান্ধব দেশ হয়েও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে তলানিতেই পড়ে আছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ‘ভ্রমণ ও পর্যটন প্রতিযোগী সক্ষমতা প্রতিবেদন-২০১৭’ অনুযায়ী ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫তম। পর্যটনের বিকাশে ২০১০ সালে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড- বিটিবি প্রতিষ্ঠা করা হলেও ৯ বছরে পর্যটন নিয়ে কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হয়নি। পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দিবসে র্যালি ও সভা-সেমিনারেই সীমাবদ্ধ দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশ।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছর বিশ্বের মোট জিডিপির ১০ দশমিক ৪ শতাংশ আসে ভ্রমণ ও পর্যটন খাত থেকে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এ খাতের অবদান ছিল ২ হাজার ৯৩৯ বিলিয়ন ডলার যা সমগ্র অর্থনীতির ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটনে কর্মসংস্থান ছিল ১৭৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন, যা মোট কর্মসংস্থানের ৯ দশমিক ৩ ভাগ। গত পাঁচ বছরে প্রতি পাঁচটি নতুন চাকরির একটি সৃষ্টি হয়েছে পর্যটন খাতে। এ অঞ্চলে ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক পর্যটকরা খরচ করে ৫২৯ বিলিয়ন ডলার যা পুরো রপ্তানি আয়ের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক পর্যটকদের ৮১ ভাগ ভ্রমণ করেন অবসর কাটাতে, বাকিরা ব্যবসায়িক কাজে। বাংলাদেশ সম্পর্কে চলতি বছর সংস্থাটি কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ না করলেও ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে বৈশ্বিক জিডিপির ১০ দশমিক ৪ শতাংশ এসেছে পর্যটন থেকে, যেখানে বাংলাদেশে এই খাতের অবদান ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বের মোট কর্মসংস্থানের ৯ দশমিক ৯ শতাংশ ছিল পর্যটন খাতে, যেখানে বাংলাদেশে ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ। এদিকে ২০১৭ সালে বিদেশি পর্যটক থেকে থাইল্যান্ড আয় করে ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের আয় ছিল মাত্র দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। বিদেশি পর্যটক থেকে ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মিয়ানমারের আয়ও ছিল বাংলাদেশের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পর্যটন বোর্ডে পাঠানো হিসাবে গত বছর বিদেশি পর্যটক থেকে বাংলাদেশের আয় দশমিক ০২ শতাংশের মতো বেড়েছে। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশে পর্যটন শিল্প থেকে কর্মসংস্থান এর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে।
আর আমাদের কক্সবাজারে পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর সুযোগ করে দিয়েছে কক্সবাজারের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কক্সবাজার সিটি কলেজ। ২০১৫ সাল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে এই কলেজে শুরু হয়েছে ৪ বছর মেয়াদি Tourism and Hospitality এর উপর BBA কোর্স। কক্সবাজার সিটি কলেজ সহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে মাত্র নয়টি কলেজে এই কোর্স চালু আছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও এই কোর্স চালু আছে। যেহেতু ভবিষ্যতে এই শিল্পের সম্ভাবনা অনেক বেশি, তাই আরো বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই কোর্স চালু করা উচিত।
আমাদের কক্সবাজার যেহেতু পর্যটনের একটি প্রাণকেন্দ্র, তাই কক্সবাজার সিটি কলেজের পর্যটন শিক্ষার বিষয়ে এই কোর্স চালু করাটা খুবই যৌক্তিক। আমাদের কক্সবাজারে প্রতিদিন হাজার হাজার বিদেশি পর্যটন আসেন ভ্রমণ করতে। তাদের সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা এবং বিভিন্ন স্থান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানোর জন্য প্রয়োজন ভ্রমণ গাইড। কিন্তু আমাদের কক্সবাজারে প্রয়োজনের তুলনায় ভ্রমণ গাইডের সংখ্যা খুবই কম। একারণে এই সেক্টরে কর্মসংস্থান করার বিরাট সুযোগ রয়েছে। পর্যটন শিক্ষার মাধ্যমে খুব সহজেই এই পেশায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করা যায়। বিশেষ করে যারা খুব ভ্রমন পিপাসু তাদের জন্য এই পেশা অনেক ফলপ্রসূ হবে। একসাথে উপার্জনও হবে আর হবে ভ্রমণও। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক হওয়ার ফলে খুব সহজেই একটি খোলা জীপে চড়ে সমুদ্র ও পাহাড়ের নান্দনিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
মেয়েদের কর্মসংস্থান এর জন্য পর্যটন শিক্ষা অনেক সুযোগ করে দিয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন উন্নত মানের হোটেল মোটেল রেস্টুরেন্টে মেয়েদেরই বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। সেই ক্ষেত্রে মেয়েদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করার জন্য পর্যটন শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান চাকরির বাজারে চাকরি পাওয়া অনেক দূর্লভ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু একজন চাইলেই Tourism and Hospitality Management এর কোর্সটি কমপ্লিট করেই সহজেই একটি চাকরি করে দিতে পারেন অথবা কয়েকজন সমমনা বন্ধু নিয়ে একটা ট্রাভেল এজেন্সি চালাতে পারেন। এতে যেমন ভালো আয়ও হবে এবং মনের প্রশান্তির জন্য ভ্রমণ করাটাও হয়ে যাবে। এককথায় যারা স্বাধীন ভাবে জীবন যাপন করতে আগ্রহী তাদের জন্য এই পেশাটি একদম উপযোগী।
আমাদের কক্সবাজারে আগে পর্যটন নিয়ে পড়ালেখা করার কোন সুযোগ ছিলো না। কিন্তু বর্তমানে কক্সবাজার সিটি কলেজ এর কল্যাণে এই বিষয়ে বিবিএ কোর্স চালু হওয়ায় অত্র এলাকার যুব সমাজের জন্য বিরাট এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। আমাদের কক্সবাজারে পর্যটকদের তুলনায় ভ্রমণ গাইড এর সংখ্যা অনেক কম। অদূর ভবিষ্যতে এই পেশা দেশের অগ্রগতিতে বিশাল অবদান রাখবে। ইতিমধ্যে উন্নত দেশ গুলোতে এই পেশা অনেক আকর্ষণীয় একটি পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিছু বছরের মধ্যে আমাদের দেশেও এই পেশা অনেক সমৃদ্ধ হবে। তাই আমাদের দেশে এই সেক্টরে ভ্রমণ গাইড এর অনেক চাহিদা বর্তমানেও রয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক সমৃদ্ধ হবে।
বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক ও ঐতিহ্যের সম্পদের রানী বলা হয়ে থাকে। দেশে অনেক জায়গা রয়েছে সেগুলো কাজে লাগিয়ে পর্যটন সেক্টরকে আরও ভালো করার সুযোগ রয়েছে। আর এসব পর্যটন জায়গাগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে অনেক নামিদামি তারকা হোটেল এবং রিসোর্ট। এসব স্থান সুদক্ষ কর্মীর অভাবে ভালোভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। পর্যাপ্ত পরিমাণে ট্যুরিস্ট গাইড ও হোটেল সার্ভিসিং কর্মকর্তার অভাবে বিদেশী পর্যটক কম আসে। এমনকি এ পেশায় কাজ করে বিদেশে ভালো করার সুযোগ রয়েছে। তাই আমাদের দেশে এই পেশার গুরুত্ব অনেক। এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে পারলে নিজের কর্মসংস্থান এর পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।
লেখকঃ মোঃ তারেক আজিজ
কক্সবাজার
No comments